অকালবোধন
– পায়েল সাহু
রোজকার মতো আজও ঠাম্মির গলা জড়িয়ে রুপকথার গল্প শোনার বায়না করে চার বছরের ছোট্ট মেয়ে, ফুল। জন্মের পর তার ভীষণ মিষ্টি, গাবলু গুবলু চেহারার জন্য ঠাম্মি এই নাম দিয়েছেন তার।
সদ্য একমাস হলো বড় স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে ফুল, গাড়ি করে অনেকদূর। সঙ্গে অবশ্যই তার মা যায় কিন্তু বাড়ি ফিরে আগে সমস্ত গল্প তার বলা চাই ঠাম্মীকে। আর দুপুর বেলা ব্যঙ্গমা ব্যাঙ্গমী, রাজা রানী, পরীদের গল্প শুনতে শুনতে সে ঘুমিয়ে পড়ে, এটা তার রোজকার রুটিন।
কিন্তু ঠাম্মি আজ বললেন “আজ তোকে মা দুর্গার অকাল বোধনের গল্প শোনাবো ফুল.. “
ফুল অবাক হয়ে বলে “অকাল বোধন মানে কি গো?”
ঠাম্মি বোঝান অকাল বোধন মানে পূজার উপযুক্ত সময়ের আগেই শত্রু নিধনের শক্তি অর্জন করার জন্য রামচন্দ্র শরৎকালে মা দূর্গার পুজো করেন আর সেই থেকে এই সময়েই দুর্গা পূজার শুরু হয় আর এই পুজো ‘অকাল বোধন’ নামেই পরিচিত।
ফুলের স্কুল যাওয়ার পুল কারের কাকু ফুলকে খুব ভালবাসে। গাড়ি থেকে কোলে করে নামায়,গালে চুমু দেয়। মায়ের হাত ধরতেই দেয় না ফুলকে, নিজে স্কুলের গেটে ঢুকিয়ে দেয়। গাড়িতে আরও অনেক বাচ্ছা থাকলেও ফুলের প্রতি গাড়ি কাকুর টান একটু বেশি।
সেদিন টাটা সুমো গাড়িটার পেছন দিকের সিটে বসেছিলো ফুল তার মায়ের সঙ্গে। রোজের মতো সেদিনও গাড়ী থেকে নামাতে এসে ফুলের গাড়ী কাকু নিজেই উঠে বসে পড়ে গাড়ীর ব্যাক সিটে। আর ফুলের মাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ফুলের বুকে, পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। ফুলের মা চোখের সামনে সবটা দেখে কেমন যেন ভয় পেয়ে যায়, কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলে মুহুর্তের জন্য।কোনমতে গাড়ী থেকে নেমে ফুলকে কোলে নিয়ে নেয় আর হনহন করে স্কুলের গেটের দিকে এগোতে থাকে আর ফুলের কানে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘এরপর থেকে গাড়ীকাকুকে বলবে- আমার গায়ে হাত দিও না, ভাল লাগে না। কিছুতেই যেন কাকু তোমাকে ছুঁতে না পারে’।
সেদিনই রাতে ফুলের বাবার সঙ্গে অনেক আলোচনা করে ফুলের মা মাত্র চার বছরের ফুলকে বোঝায় good touch, bad touch এর মানে, শরীরের কোনটা তার private part, কোথায় কোথায় ছুঁতে দিতে নেই কাউকে, কারো কোলে বসতে নেই, আরও অনেক অনেক কিছু। অবাক ফুল প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যায়। আর ফুলের মা চোখের জল সামলিয়ে তার দুধের শিশুকে বোঝাতে থাকে দুনিয়ার কদর্য রূপ।
যে শিশু মন কল্পনার রাজ্যে ভেসে বেড়াতো সেই শিশু মনের অকাল বোধন করতেই হলো সমাজের কিছু অসুরের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। অকাল বোধন করতেই হলো সহজ সরল কচি নরম মনটার, যে কিনা এখন থেকে ভাবতে শিখবে, বুঝতে চাইবে যে হাতটা তাকে ছুঁচ্ছে সেটা কি ভালবাসতে আসছে, নাকি ক্ষতি করতে চাইছে। আজকাল ফুল রুপকথার গল্প শুনতে চায়না ঠাম্মির কাছে, ফুলের এখন সব গল্প শুধু good touch আর bad touch নিয়ে।
এভাবেই আজ ঘরে ঘরে সচেতনতার নামে ‘অকাল বোধন’ চলছে ফুলের মতো ছোট্ট ছোট্ট মা দুর্গার, কখনো কখনো কোল আলো করে আসা ছোট্ট গোপালেরও। আর এই অকাল বোধন করতেই হবে শিশুগুলিকে বাঁচাতে গেলে এমনই আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা, এমনই নিষ্ঠুর লোকজনে ভর্তি আমাদের সমাজ যারা অবুঝ শিশুগুলিকেও অত্যাচার করতে পিছু হটে না ।
অসাধারণ…… হৃদয়স্পর্শী লেখা…….
অনেক অনেক ধন্যবাদ